সম্প্রসারিত মূল পাঠ্যক্রম (Expanded Core Curriculum - ECC)

সম্প্রসারিত মূল পাঠ্যক্রম (Expanded Core Curriculum - ECC)

ভূমিকা
সম্প্রসারিত মূল পাঠ্যক্রম (ECC) হল একটি বিশেষ শিক্ষাগত কাঠামো যা দৃষ্টি প্রতিবন্ধী বা দৃষ্টিহীন শিক্ষার্থীদের জন্য তৈরি করা হয়েছে। এটি তাদের দৈনন্দিন জীবনের কার্যকারিতা, স্বাধীনতা, সামাজিক দক্ষতা এবং কর্মজীবনের প্রস্তুতি বাড়াতে সাহায্য করে। ECC সাধারণ শিক্ষাক্রমের বাইরে গিয়ে এমন দক্ষতা শেখায় যা দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের স্বাধীনভাবে জীবনযাপন এবং সমাজে অংশগ্রহণের জন্য অপরিহার্য। এই নোটগুলি ECC-এর মূল ধারণা, উপাদান, উদাহরণ এবং বাস্তবায়নের বিস্তারিত বিবরণ প্রদান করে, যা শিক্ষক, অভিভাবক এবং শিক্ষাবিদদের জন্য একটি প্রামাণিক গাইড হিসেবে কাজ করবে।

ECC-এর মূল ধারণা
ECC-এর মূল লক্ষ্য হল দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের এমন দক্ষতা শেখানো যা তাদের সাধারণ শিক্ষাক্রমের পাশাপাশি অতিরিক্ত কার্যকরী এবং জীবন দক্ষতা প্রদান করে। এটি নিশ্চিত করে যে শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র একাডেমিক জ্ঞানই অর্জন করে না, বরং স্বাধীনভাবে জীবনযাপন, সমাজে মিশে চলা এবং কর্মজীবনে সফল হওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। ECC-এর প্রতিটি উপাদান শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত চাহিদা এবং দক্ষতার উপর ভিত্তি করে ব্যক্তিগতকৃতভাবে ডিজাইন করা হয়। এটি শিক্ষার্থীদের স্ব-নির্ভরতা, আত্মবিশ্বাস এবং সমাজে অংশগ্রহণের ক্ষমতা বাড়ায়।

ECC-এর নয়টি মূল উপাদান
ECC-এর নয়টি মূল ক্ষেত্র নিম্নরূপ, প্রতিটির বিস্তারিত বর্ণনা এবং উদাহরণ সহ:

1.     ক্ষতিপূরণমূলক দক্ষতা (Compensatory Skills)

o    ধারণা: এই দক্ষতাগুলি শিক্ষার্থীদের দৃষ্টিহীনতার কারণে যে সীমাবদ্ধতাগুলি তৈরি হয় তা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করে। এর মধ্যে রয়েছে ব্রেইল পড়া-লেখা, অডিও উপকরণ ব্যবহার, এবং অন্যান্য বিকল্প পঠন-লেখন পদ্ধতি।

o    উদাহরণ: একজন শিক্ষার্থী ব্রেইল ব্যবহার করে বই পড়তে শিখছে। শিক্ষক শিক্ষার্থীকে ব্রেইল বর্ণমালা শেখান এবং সহজ বাক্য তৈরি করতে সাহায্য করেন।

o    পাঠ পরিকল্পনা:

§  উদ্দেশ্য: শিক্ষার্থী ৬ মাসের মধ্যে ব্রেইল বর্ণমালার ৮০% সঠিকভাবে পড়তে পারবে।

§  কার্যক্রম: ব্রেইল কার্ড দিয়ে শব্দ শনাক্তকরণ, ব্রেইল টাইপরাইটারে লেখার অনুশীলন।

§  মূল্যায়ন: শিক্ষার্থীকে একটি সহজ ব্রেইল প্যাসেজ পড়তে দেওয়া এবং তার নির্ভুলতা পরীক্ষা করা।

2.     ওরিয়েন্টেশন এবং গতিশীলতা (Orientation and Mobility)

o    ধারণা: এটি শিক্ষার্থীদের নিরাপদে এবং স্বাধীনভাবে তাদের পরিবেশে চলাচল করতে শেখায়। এর মধ্যে হোয়াইট কেন, মানচিত্র পড়া, এবং পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা অন্তর্ভুক্ত।

o    উদাহরণ: শিক্ষার্থীকে স্কুলের হলওয়েতে হোয়াইট কেন ব্যবহার করে একটি নির্দিষ্ট ক্লাসরুমে পৌঁছাতে শেখানো।

o    পাঠ পরিকল্পনা:

§  উদ্দেশ্য: শিক্ষার্থী ৩ মাসের মধ্যে হোয়াইট কেন ব্যবহার করে স্কুলের প্রধান গেট থেকে ক্লাসরুমে পৌঁছাতে পারবে।

§  কার্যক্রম: হোয়াইট কেন ধরার কৌশল শেখানো, সিমুলেটেড বাধার মধ্য দিয়ে চলাচলের অনুশীলন।

§  মূল্যায়ন: শিক্ষার্থী কতটা নিরাপদে এবং স্বাধীনভাবে রুটটি সম্পন্ন করেছে তা পর্যবেক্ষণ।

3.     সামাজিক মিথস্ক্রিয়া দক্ষতা (Social Interaction Skills)

o    ধারণা: শিক্ষার্থীদের সামাজিক আচরণ, শিষ্টাচার, এবং কার্যকর যোগাযোগ শেখানো হয়। এটি তাদের সম্পর্ক গড়ে তুলতে এবং সামাজিক পরিস্থিতিতে অংশগ্রহণে সাহায্য করে।

o    উদাহরণ: শিক্ষার্থীকে গ্রুপে কথোপকথন শুরু করার জন্য শিষ্টাচার শেখানো, যেমন নিজের পরিচয় দেওয়া।

o    পাঠ পরিকল্পনা:

§  উদ্দেশ্য: শিক্ষার্থী ৪ মাসের মধ্যে গ্রুপে স্বাভাবিকভাবে কথোপকথন শুরু করতে পারবে।

§  কার্যক্রম: রোল-প্লে, গ্রুপ ডিসকাশন, এবং সামাজিক পরিস্থিতির সিমুলেশন।

§  মূল্যায়ন: শিক্ষার্থী কতটা আত্মবিশ্বাসের সাথে গ্রুপে অংশ নিচ্ছে তা মূল্যায়ন।

4.     স্বাধীন জীবনযাপন দক্ষতা (Independent Living Skills)

o    ধারণা: এটি শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন কাজ, যেমন রান্না, পরিচ্ছন্নতা, এবং ব্যক্তিগত ব্যবস্থাপনা, শেখায়।

o    উদাহরণ: শিক্ষার্থীকে নিরাপদে স্যান্ডউইচ তৈরি করতে শেখানো।

o    পাঠ পরিকল্পনা:

§  উদ্দেশ্য: শিক্ষার্থী ৬ মাসের মধ্যে একটি সহজ খাবার তৈরি করতে পারবে।

§  কার্যক্রম: রান্নাঘরের সরঞ্জাম চেনানো, নিরাপদে ছুরি ব্যবহার শেখানো।

§  মূল্যায়ন: শিক্ষার্থী কতটা সঠিকভাবে এবং নিরাপদে খাবার তৈরি করেছে তা পরীক্ষা।

5.     বিনোদন এবং অবসর দক্ষতা (Recreation and Leisure Skills)

o    ধারণা: শিক্ষার্থীদের খেলাধুলা, শখ, এবং অবসর কার্যক্রমে অংশগ্রহণের দক্ষতা শেখানো।

o    উদাহরণ: শিক্ষার্থীকে অডিও-ভিত্তিক গেম বা সঙ্গীত শেখানো।

o    পাঠ পরিকল্পনা:

§  উদ্দেশ্য: শিক্ষার্থী ৩ মাসের মধ্যে একটি অডিও গেমে অংশ নিতে পারবে।

§  কার্যক্রম: অডিও গেমের নিয়ম শেখানো, গ্রুপে খেলার অনুশীলন।

§  মূল্যায়ন: শিক্ষার্থী কতটা সক্রিয়ভাবে গেমে অংশ নিচ্ছে তা পর্যবেক্ষণ।

6.     কর্মজীবন শিক্ষা (Career Education)

o    ধারণা: শিক্ষার্থীদের কর্মজীবনের প্রস্তুতি, চাকরির আবেদন, এবং পেশাগত দক্ষতা শেখানো।

o    উদাহরণ: শিক্ষার্থীকে সিভি তৈরি করতে শেখানো।

o    পাঠ পরিকল্পনা:

§  উদ্দেশ্য: শিক্ষার্থী ৬ মাসের মধ্যে একটি মৌলিক সিভি তৈরি করতে পারবে।

§  কার্যক্রম: সিভি ফরম্যাট শেখানো, কম্পিউটারে টাইপিং অনুশীলন।

§  মূল্যায়ন: শিক্ষার্থীর তৈরি সিভি পরীক্ষা করা।

7.     প্রযুক্তির ব্যবহার (Assistive Technology)

o    ধারণা: শিক্ষার্থীদের স্ক্রিন রিডার, ম্যাগনিফায়ার, এবং অন্যান্য প্রযুক্তি ব্যবহার শেখানো।

o    উদাহরণ: শিক্ষার্থীকে JAWS স্ক্রিন রিডার ব্যবহার করে কম্পিউটারে কাজ করতে শেখানো।

o    পাঠ পরিকল্পনা:

§  উদ্দেশ্য: শিক্ষার্থী ৪ মাসের মধ্যে JAWS ব্যবহার করে একটি ডকুমেন্ট পড়তে পারবে।

§  কার্যক্রম: JAWS-এর মৌলিক কমান্ড শেখানো, ডকুমেন্ট নেভিগেশন অনুশীলন।

§  মূল্যায়ন: শিক্ষার্থী কতটা সঠিকভাবে ডকুমেন্ট পড়ছে তা পরীক্ষা।

8.     স্ব-নির্ধারণ (Self-Determination)

o    ধারণা: শিক্ষার্থীদের নিজের লক্ষ্য নির্ধারণ, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, এবং নিজের পক্ষে কথা বলার দক্ষতা শেখানো।

o    উদাহরণ: শিক্ষার্থীকে IEP মিটিংয়ে নিজের চাহিদা প্রকাশ করতে শেখানো।

o    পাঠ পরিকল্পনা:

§  উদ্দেশ্য: শিক্ষার্থী ৬ মাসের মধ্যে নিজের শিক্ষাগত চাহিদা বর্ণনা করতে পারবে।

§  কার্যক্রম: স্ব-প্রকাশের কৌশল শেখানো, মক মিটিংয়ে অংশগ্রহণ।

§  মূল্যায়ন: শিক্ষার্থী কতটা স্পষ্টভাবে নিজের চাহিদা প্রকাশ করছে তা মূল্যায়ন।

9.     সংবেদী দক্ষতা (Sensory Efficiency)

o    ধারণা: শিক্ষার্থীদের তাদের অবশিষ্ট দৃষ্টি, শ্রবণ, এবং অন্যান্য সংবেদী ক্ষমতা সর্বোত্তমভাবে ব্যবহার করতে শেখানো।

o    উদাহরণ: শিক্ষার্থীকে শব্দের মাধ্যমে পরিবেশের বাধা শনাক্ত করতে শেখানো।

o    পাঠ পরিকল্পনা:

§  উদ্দেশ্য: শিক্ষার্থী ৩ মাসের মধ্যে শব্দের মাধ্যমে ৫টি বাধা শনাক্ত করতে পারবে।

§  কার্যক্রম: শব্দ শনাক্তকরণ গেম, পরিবেশে শ্রবণ অনুশীলন।

§  মূল্যায়ন: শিক্ষার্থী কতটা সঠিকভাবে শব্দ শনাক্ত করছে তা পরীক্ষা।

ECC বাস্তবায়নের কৌশল

1.     শিক্ষার্থীর মূল্যায়ন: শিক্ষার্থীর বর্তমান দক্ষতা, চাহিদা, এবং শক্তি মূল্যায়ন করুন। এর জন্য শিক্ষাগত, শারীরিক, এবং সামাজিক মূল্যায়ন পদ্ধতি ব্যবহার করুন।

2.     ব্যক্তিগতকৃত পরিকল্পনা: ECC-এর প্রতিটি উপাদান শিক্ষার্থীর নির্দিষ্ট চাহিদার উপর ভিত্তি করে ডিজাইন করুন।

3.     অভিভাবক ও শিক্ষকের সম্পৃক্ততা: অভিভাবক এবং শিক্ষকদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখুন এবং তাদের মতামত গ্রহণ করুন।

4.     প্রযুক্তি এবং সম্পদ: উপযুক্ত প্রযুক্তি এবং শিক্ষণ সামগ্রী ব্যবহার করুন, যেমন ব্রেইল বই, স্ক্রিন রিডার, এবং হোয়াইট কেন।

5.     নিয়মিত মূল্যায়ন: শিক্ষার্থীর অগ্রগতি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করুন এবং প্রয়োজনে পাঠ পরিকল্পনা সংশোধন করুন।

ECC-এর গুরুত্ব
ECC শিক্ষার্থীদের কেবল একাডেমিক দক্ষতা নয়, বরং জীবনযাপনের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবহারিক দক্ষতাও শেখায়। এটি তাদের আত্মবিশ্বাস বাড়ায় এবং সমাজে সম্পূর্ণ অংশগ্রহণের সুযোগ প্রদান করে। উদাহরণস্বরূপ, একজন শিক্ষার্থী যিনি ECC-এর মাধ্যমে স্বাধীনভাবে চলাচল এবং সামাজিক দক্ষতা শিখেছেন, তিনি আরও সহজে সমাজে মিশতে এবং কর্মজীবনে সফল হতে পারেন।

উপসংহার
ECC হল দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য একটি অপরিহার্য শিক্ষাগত কাঠামো যা তাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বাধীনতা এবং সাফল্য অর্জনে সাহায্য করে। এই বিস্তারিত নোটগুলি শিক্ষকদের জন্য একটি ব্যাপক গাইড হিসেবে কাজ করবে এবং বই প্রকাশের জন্য উপযুক্ত। প্রতিটি উপাদানের জন্য সুনির্দিষ্ট পাঠ পরিকল্পনা এবং বাস্তব উদাহরণ শিক্ষার্থীদের চাহিদা পূরণে সহায়ক হবে। নিয়মিত মূল্যায়ন এবং শিক্ষার্থী-কেন্দ্রিক পদ্ধতির মাধ্যমে ECC-এর পূর্ণ সম্ভাবনা কাজে লাগানো সম্ভব।

Post a Comment

Please Select Embedded Mode To Show The Comment System.*

Previous Post Next Post