Bronfenbrenner ecological systems theory
শিশুর সমাজায়নে ব্রনফেনব্রেনারের ইকোলজিক্যাল
ডেভেলপমেন্ট তত্ত্ব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মানব উন্নয়ন এবং শিক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে
এই তত্ত্বটি খুবই কার্যকর।
উরি ব্রনফেনব্রেনার একজন মার্কিন মনোবিজ্ঞানী
ছিলেন। তিনি ডাক্তার আলেকজান্ডার ব্রনফেনব্রেনার এবং ইউজেনিয়া কামেনেটস্কাজার সন্তান।
তিনি ১৯১৭ সালের ২৯ এপ্রিল রাশিয়ার মস্কোতে জন্মগ্রহণ করেন। ছয় বছর বয়সে তিনি যুক্তরাষ্ট্রে
চলে আসেন। ২০০৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
বিকাশমূলক মনোবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে তিনি অনেক
প্রশংসিত। তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাপ্রসূত কাজ ছিল ইকোলজিক্যাল সিস্টেম তত্ত্ব।
এই তত্ত্বে তিনি চারটি কেন্দ্রীয় সিস্টেম বা স্তরের বর্ণনা করেছেন, যথা মাইক্রো সিস্টেম,
মেসো সিস্টেম, এক্সো সিস্টেম এবং ম্যাক্রো সিস্টেম। পরবর্তীতে তিনি একটি সময় সম্পর্কিত
পঞ্চম সিস্টেম, ক্রোনো সিস্টেম, যুক্ত করেন।
ব্রনফেনব্রেনারের ইকোলজিক্যাল সিস্টেম তত্ত্ব
শিশুর আশেপাশের পরিবেশের গুণগতমান এবং বিষয়বস্তুতে গুরুত্ব দেয়। তার মতে, শিশুর বিকাশের
সাথে সাথে পরিবেশের সাথে পারস্পরিক সম্পর্ক আরও জটিল হয়ে ওঠে। এই জটিলতার সম্ভাবনা
বৃদ্ধি পায় কারণ একটি শিশুর শারীরিক এবং জ্ঞানীয় গঠন ক্রমাগত বৃদ্ধি পায় এবং পরিণত
হয়।
শিশুর বিকাশকে বিভিন্ন ক্ষেত্র বা ডোমেইনে
ভাগ করা যেতে পারে, যেমন: চিন্তাশক্তি, ভাষা, সামাজিক, আবেগ, শারীরিক এবং নৈতিক। এই
বিকাশ বিভিন্ন প্রভাব দ্বারা গঠিত হয়। উরি ব্রনফেনব্রেনার অনুযায়ী, যে পরিবেশে একটি
শিশু বড় হয়, সেটি তার বিকাশকে গঠন এবং প্রভাবিত করবে। তিনি এই পরিবেশকে ইকোলজিক্যাল সিস্টেম নামে অভিহিত করেছেন।
ইকোলজিক্যাল সিস্টেমে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে সেই শারীরিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আর্থিক,
রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় পরিবেশ, যেখানে শিশু পরিণত হয়ে একজন প্রাপ্তবয়স্কে রূপান্তরিত
হয়। ব্রনফেনব্রেনার শিশুর বিকাশ বোঝার এবং ব্যাখ্যা করার জন্য শিশুর ইকোলজিক্যাল সিস্টেমের
তদন্ত করার সুপারিশ করেন।
ব্রনফেনব্রেনার এই তত্ত্বটি ১৯৬০-এর দশকের
শেষের দিকে তৈরি করেছিলেন। এই সময়ে, অধিকাংশ মনোবিজ্ঞান গবেষণা ল্যাবরেটরিতে ঘটেছিল
এবং পরীক্ষামূলক গবেষণার উপর ভিত্তি করে ছিল। ব্রনফেনব্রেনার এই পদ্ধতির প্রতি খুব
সমালোচক ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন না যে মানুষ একটি ল্যাবের মধ্যে তাদের উপর নজরদারি
করা হলে স্বাভাবিক ও স্বাস্থ্যকরভাবে আচরণ করতে পারে। ফলস্বরূপ, তিনি মনে করতেন যে
এই পরীক্ষামূলক গবেষণার ফলাফল সঠিক বা বৈধ নয় এবং এটি কোন মূল্যবান তথ্য দেয় না।
যখন ব্রনফেনব্রেনার তার ইকোলজিক্যাল সিস্টেম
তত্ত্ব তৈরি করতে শুরু করেন, তার পদ্ধতি তার দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিফলিত করে। তার গবেষণায়
কোন ল্যাবরেটরি ভিত্তিক পরীক্ষা অন্তর্ভুক্ত ছিল না। তিনি একটি ভিন্ন পদ্ধতি গ্রহণ
করেছিলেন এবং তার তত্ত্বটি পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে তৈরি করেছিলেন। ব্রনফেনব্রেনার
শিশুদের আচরণ এবং ক্রিয়াকলাপগুলি অধ্যয়ন করেন যখন তারা তাদের দৈনন্দিন জীবনে — স্কুলে,
বাড়িতে, গ্রুপ এবং ক্লাবে অংশ নিয়ে এবং একসাথে খেলার সময় ব্যস্ত থাকে।
ব্রনফেনব্রেনারের ইকোলজিক্যাল থিওরি
(Ecological Systems Theory) শিশুর বিকাশকে পরিবেশের বিভিন্ন স্তরের প্রভাবের ওপর ভিত্তি
করে ব্যাখ্যা করে। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, একটি শিশুর বিকাশ শুধুমাত্র জৈবিক এবং মানসিক
প্রক্রিয়ার ওপর নির্ভর করে না, বরং এটি তার পারিপার্শ্বিক বিভিন্ন সামাজিক ও পরিবেশগত
স্তরের প্রভাবেও গঠিত হয়।
ব্রনফেনব্রেনার তার তত্ত্বকে পাঁচটি স্তরে
বিভক্ত করেছেন, যা একে অপরের ওপর নির্ভরশীল এবং শিশুর জীবনের বিভিন্ন অংশকে প্রভাবিত
করে। এগুলো হলো:
1. মাইক্রোসিস্টেম
(Microsystem)
মাইক্রোসিস্টেম হলো শিশুর তাৎক্ষণিক পরিবেশ
বা সরাসরি সম্পর্কগুলির সমষ্টি, যেখানে শিশু নিয়মিতভাবে অংশগ্রহণ করে। এর মধ্যে পরিবার,
স্কুল, বন্ধুবান্ধব, শিক্ষক, প্রতিবেশী প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত থাকে।
উদাহরণ:
একটি শিশু তার পরিবারের সদস্যদের সাথে
কেমন আচরণ করছে, তা তার আচার-ব্যবহারের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলে। যদি একটি পরিবার শিশুকে
ভালোবাসা, সমর্থন এবং সুরক্ষা প্রদান করে, তবে সেই শিশু আত্মবিশ্বাসী এবং সামাজিক হতে
পারে। অন্যদিকে, যদি পরিবারে অবহেলা বা অসন্তোষ থাকে, শিশুর আচার-ব্যবহারে নেতিবাচক
প্রভাব পড়তে পারে।
মাইক্রোসিস্টেম:
- নিকটস্থ পরিবার (পিতামাতা, ভাইবোন, দাদী-নানী)
- স্কুল পরিবেশ (শিক্ষক, সহপাঠী)
- সমবয়সী এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু
- অতিরিক্ত কার্যকলাপ (ক্রীড়া দল, ক্লাব)
- স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারী (শিশু বিশেষজ্ঞ, দন্তচিকিৎসক)
- প্রতিবেশী খেলার সঙ্গী
- শিশু যত্নের ব্যবস্থা (ডে কেয়ার, বেবিসিটার)
2. মেসোসিস্টেম
(Mesosystem)
মেসোসিস্টেম হল মাইক্রোসিস্টেমের বিভিন্ন
অংশগুলির মধ্যে সম্পর্ক বা যোগাযোগ। এটি বিভিন্ন মাইক্রোসিস্টেমের মিথস্ক্রিয়াকে তুলে
ধরে, যা শিশুর বিকাশের ওপর প্রভাব ফেলে।
উদাহরণ:
একটি শিশুর পরিবারের পরিবেশ এবং স্কুলের
পরিবেশের মধ্যে কিভাবে যোগাযোগ হচ্ছে তা মেসোসিস্টেমে উঠে আসে। যদি বাবা-মা এবং শিক্ষক
একে অপরের সাথে যোগাযোগ রাখে এবং শিশুর শিক্ষার প্রতি সমর্থন প্রদান করে, তাহলে শিশুর
শিক্ষা এবং সামাজিক বিকাশে ইতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।
মেসোসিস্টেম:
- পিতামাতা-শিক্ষক যোগাযোগ
- পরিবার ও সমবয়সী গোষ্ঠীর মিথস্ক্রিয়া
- স্কুল-প্রতিবেশী সংযোগ
- পরিবার-স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীর সম্পর্ক
- বিভিন্ন বন্ধু গোষ্ঠীর মধ্যে মিথস্ক্রিয়া
- পরিবার-অতিরিক্ত কার্যকলাপ সংযোগ
- ধর্মীয় সম্প্রদায় ও পরিবারের মিথস্ক্রিয়া
3. এক্সোসিস্টেম
(Exosystem)
এক্সোসিস্টেম হল শিশুর বাইরে থাকা পরিবেশ
যা শিশুকে সরাসরি প্রভাবিত না করলেও তার জীবনে প্রভাব ফেলে। এই স্তরে পিতামাতার কর্মক্ষেত্র,
সামাজিক সেবা, সরকারী নীতি প্রভৃতি অন্তর্ভুক্ত থাকে।
উদাহরণ:
শিশুর পিতামাতার কর্মক্ষেত্র থেকে অনেক
সময় শিশুর জীবন প্রভাবিত হয়। যদি কোনো বাবা বা মা দীর্ঘ সময় কাজ করেন এবং বাড়িতে
খুব কম সময় দেন, তাহলে শিশুর মানসিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে, যেমন বাবা-মা
থেকে দূরত্ব অনুভব করা।
এক্সোসিস্টেম:
- পিতামাতার কর্মস্থল ও নীতিমালা
- বর্ধিত পারিবারিক নেটওয়ার্ক
- স্থানীয় সম্প্রদায় সংগঠন
- স্কুল বোর্ডের সিদ্ধান্ত
- সামাজিক সেবা ও সহায়তা ব্যবস্থা
- গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম
- স্থানীয় সরকারি নীতিমালা
- গণপরিবহন ব্যবস্থা
4. ম্যাক্রোসিস্টেম
(Macrosystem)
ম্যাক্রোসিস্টেম হল বৃহত্তর সামাজিক-সাংস্কৃতিক
পরিমণ্ডল, যা একটি শিশুর পারিপার্শ্বিকের সামাজিক মূল্যবোধ, সংস্কৃতি, অর্থনীতি এবং
রাজনীতিকে নির্দেশ করে। এটি শিশু এবং তার পরিবারকে সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বিশ্বাস,
মূল্যবোধ এবং প্রথার মাধ্যমে প্রভাবিত করে।
উদাহরণ:
একটি সমাজের সংস্কৃতি যদি শিক্ষার ওপর
গুরুত্ব দেয়, তাহলে সেই সংস্কৃতির শিশুরা শিক্ষায় উৎসাহিত হবে এবং একে বড় একটি লক্ষ্য
হিসেবে বিবেচনা করবে। অন্যদিকে, যদি কোনো সমাজে শিক্ষাকে খুব বেশি গুরুত্ব না দেওয়া
হয়, তাহলে সেই পরিবেশে বড় হওয়া শিশুরা শিক্ষার প্রতি অনাগ্রহী হতে পারে।
ম্যাক্রোসিস্টেম:
- সাংস্কৃতিক নিয়ম ও প্রত্যাশা
- সামাজিক ও অর্থনৈতিক কারণ
- শিক্ষানীতি ও মান
- স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা
- প্রযুক্তিগত উন্নতি
- পরিবেশগত মনোভাব ও নীতিমালা
- লিঙ্গ ভূমিকা ও প্রত্যাশা
- ধর্মীয় বা দার্শনিক মতাদর্শ
5. ক্রোনোসিস্টেম
(Chronosystem)
ক্রোনোসিস্টেম হলো সময়ের সাথে সাথে শিশুর
জীবনের মধ্যে ঘটমান পরিবর্তন এবং তার পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির পরিবর্তনের প্রভাব।
এটি কিভাবে জীবনের বড় ঘটনা এবং পরিবর্তনগুলি (যেমন: মা-বাবার বিবাহ বিচ্ছেদ, স্থান
পরিবর্তন, যুদ্ধ) শিশুর বিকাশকে প্রভাবিত করে তা ব্যাখ্যা করে।
উদাহরণ:
যদি একটি শিশু শৈশবে বড় কোনো পারিবারিক
সংকট যেমন মা-বাবার বিচ্ছেদের সম্মুখীন হয়, তবে এটি তার মানসিক ও সামাজিক বিকাশের
ওপর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলতে পারে। আবার, কোনো দেশ বা সমাজে অর্থনৈতিক মন্দা শিশুর
শিক্ষার সুযোগ এবং মানসিক স্থিতির ওপর প্রভাব ফেলতে পারে।
ক্রোনোসিস্টেম:
- গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা (যেমন: মহামারি, যুদ্ধ)
- প্রযুক্তিগত পরিবর্তন (যেমন: ইন্টারনেটের উত্থান, সামাজিক
মিডিয়া)
- পরিবার গঠনের পরিবর্তন (যেমন: বিবাহবিচ্ছেদ, পুনর্বিবাহ)
- শিক্ষাগত সংস্কার
- অর্থনৈতিক চক্র (বুম এবং মন্দা)
- জলবায়ু পরিবর্তন এবং পরিবেশগত পরিবর্তন
- প্রজন্মগত সাংস্কৃতিক পরিবর্তন
- ব্যক্তিগত জীবনের পরিবর্তন (যেমন: যৌবন, বিদ্যালয়ে
যাত্রা)
সারসংক্ষেপ:
ব্রনফেনব্রেনারের ইকোলজিক্যাল সিস্টেম
থিওরি বলে যে একটি শিশুর বিকাশ শুধুমাত্র তার নিজের অভিজ্ঞতা এবং আচরণের ওপর নির্ভর
করে না, বরং পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, সমাজ এবং সংস্কৃতির বিভিন্ন স্তরের প্রভাবের ওপরও
নির্ভরশীল। শিশুর মাইক্রোসিস্টেম (যেমন পরিবার, স্কুল), মেসোসিস্টেম (মাইক্রোসিস্টেমের
মিথস্ক্রিয়া), এক্সোসিস্টেম (পরোক্ষ প্রভাবক), ম্যাক্রোসিস্টেম (সামাজিক ও সাংস্কৃতিক
পরিবেশ) এবং ক্রোনোসিস্টেম (সময়ের প্রভাব) সমন্বিতভাবে শিশুর মানসিক, সামাজিক ও শারীরিক
বিকাশে ভূমিকা রাখে।
ব্রনফেনব্রেনারের এই তত্ত্ব শিশুদের বিকাশ
এবং শেখার প্রক্রিয়ায় পারিপার্শ্বিক পরিবেশের গুরুত্বকে জোর দেয় এবং শিক্ষাবিদদের
জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে।
শিক্ষাগত প্রভাব:
ব্রনফেনব্রেনারের তত্ত্বের শিক্ষাক্ষেত্রে
গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব রয়েছে। যদি শিশুর ঘরে কোনো ধরনের ভাঙন বা সমস্যা দেখা দেয়, আমাদের
শিক্ষাব্যবস্থা কি সেই ঘাটতি পূরণ করতে পারে? এই তত্ত্ব অনুযায়ী, স্কুল এবং শিক্ষকদের
জন্য স্থিতিশীল এবং দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্ক প্রদান করা জরুরি। এটি আমাদের পুরো সমাজের
স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নীতিগুলিকে সমর্থন করা হয়, যা পিতামাতার
ভূমিকা এবং তাদের সন্তানদের বিকাশের গুরুত্বকে সমর্থন করে।
ব্রনফেনব্রেনার এই বিষয়ে একমত হবেন যে, সমাজে
এমন মানসিকতার বিকাশ করা উচিত যা শিশুদের জন্য করা কাজের মূল্যায়ন করে, যেই স্তরেই
হোক না কেন: পিতামাতা, শিক্ষক, সম্প্রসারিত পরিবার, মেন্টর, কর্মস্থলের সুপারভাইজার
বা আইনপ্রণেতা—সকলের অবদানই গুরুত্বপূর্ণ।