Piaget’s theory: Cognitive Development

 Piaget’s theory: Cognitive Development

জন্মের সময় শিশু তার চারপাশের মানুষ এবং বিশ্বের সম্পর্কে কিছুই জানে না। সে কী করতে পারে তা সম্পর্কে সচেতন নয়। ধীরে ধীরে, শিশু নিজের সম্পর্কে, মানুষ এবং জিনিস সম্পর্কে ধারণা গড়ে তোলে। এটি কীভাবে ঘটে? সুইস মনোবিজ্ঞানী জঁ পিয়াজে এককভাবে জন্ম থেকে প্রাপ্তবয়স্ক অবধি জ্ঞানীয় বিকাশের একটি তত্ত্ব গড়ে তুলেছেন। তার কাজ আমাদের বোঝার প্রধান উৎস যে কীভাবে চিন্তা এবং চিন্তাশক্তি মানুষের মধ্যে জন্ম থেকে বিকশিত হয়।

সুইস মনোবিজ্ঞানী জাঁ পিয়াজে শিশু কীভাবে মানুষ এবং ঘটনাগুলো বুঝতে শেখে তা নিয়ে গবেষণা করেছিলেন। ছোট্ট শিশু কি শিখতে পারে? কোন উপায়ে শিশু এবং কিশোরেরা তাদের বুদ্ধিমত্তা প্রকাশ করে? শিশুর চিন্তাভাবনা সময়ের সাথে সাথে কী পরিবর্তিত হয়? পিয়াজের গবেষণা এই ধরনের বিষয়গুলোর উপর মনোযোগ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, শিশুরা বিশ্বকে এবং ঘটনাগুলোকে এমনভাবে দেখে যা প্রাপ্তবয়স্কদের থেকে ভিন্ন। তাদের লজিক বা যুক্তি প্রাপ্তবয়স্কদের থেকে আলাদা। শিশুদের চিন্তাভাবনার প্রকৃতি বয়সের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়। পিয়াজে তার জ্ঞানীয় বিকাশ তত্ত্বে এই পরিবর্তনগুলো ব্যাখ্যা করেছেন। যেমন, শিশু যখন বড় হয়, তার জ্ঞানের ভাণ্ডার শুধু বাড়ে না, তার চিন্তা করার পদ্ধতিও পরিবর্তিত হয়। বয়স বাড়ার সাথে সাথে শিশুর চিন্তাভাবনা আগের বয়সের তুলনায় মানগতভাবে ভিন্ন হয়।

পিয়াজে বলেছেন, চিন্তার বিকাশ চারটি ধাপের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়। প্রথম ধাপটি দুই বছর বয়স পর্যন্ত স্থায়ী হয়, যা সেন্সরি-মোটর পর্ব নামে পরিচিত। দ্বিতীয় ধাপটি ২-৬ বছর বয়স পর্যন্ত স্থায়ী হয়, যা প্রি-অপারেশনাল পর্ব। তৃতীয় ধাপটি ৭-১১ বছর বয়স পর্যন্ত, এটি কংক্রিট-অপারেশনাল পর্ব। ১২ বছর থেকে শিশুটি ফর্মাল অপারেশনস পর্যায়ে প্রবেশ করে। এই প্রতিটি ধাপে শিশুর ঘটনা বোঝার পদ্ধতি আলাদা, তাই এটি বলা ঠিক নয় যে দুই বছর বয়সী শিশু ছয় বছর বয়সী শিশুর চেয়ে কম বুদ্ধিমান।

পিয়াজে তার জ্ঞানীয় বিকাশ তত্ত্ব তৈরি করার সময় প্রধানত তার নিজের তিনটি শিশুর পর্যবেক্ষণ থেকে তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন। এই ইউনিটে এবং অন্যান্য ইউনিটে আমরা পিয়াজের শিশুদের কার্যক্রমের রেকর্ডিংগুলোর সাথে অন্য শিশুদের কার্যক্রমের বর্ণনা করব, যা বয়সের সাথে সাথে চিন্তায় যে পরিবর্তন ঘটে তা ব্যাখ্যা করতে সাহায্য করবে।

এখন, পিয়াজে বর্ণিত চিন্তার বিকাশের পর্যায়গুলো আলোচনা করার আগে আমরা কিছু প্রধান ধারণা বোঝার চেষ্টা করব, যেগুলো তার তত্ত্বের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে:

পিয়াজের তত্ত্বের কিছু মূল ধারণা

১) স্কিমাস (Schemas): পিয়াজে্র মতে, যেমন আমাদের শরীরের গঠন আমাদের পরিবেশের সাথে খাপ খাইয়ে চলে, তেমনি আমরা আমাদের মানসিক কাঠামো তৈরি করি এবং ক্রমাগত সেগুলো পরিবর্তন করি আমাদের আশেপাশের পরিবেশে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া করে এবং সেটার সাথে খাপ খাইয়ে নিতে। পিয়াজে এই মানসিক কাঠামোগুলোকে স্কিমাস বলেছেন। এই স্কিমাস আমাদের পরিবেশ বুঝতে সাহায্য করার সংগঠিত উপায়। এগুলো বয়সের সাথে পরিবর্তিত হয়। যেমন, শৈশবে এই স্কিমাসগুলো সাধারণত মোটর ক্রিয়া-প্যাটার্ন যেমন ‘চুষা’ এর মতো হয়। শিশুরা তাদের আঙুল চুষে, এবং পরে যা কিছু তাদের সামনে আসে—মা-বাবার মুখ/হাত, খেলনা বা পোশাক—এসব চুষে তারা তাদের আশেপাশের পরিবেশ সম্পর্কে ধারণা তৈরি করে। শৈশবে অন্যান্য স্কিমাস হতে পারে ‘ফেলে দেওয়া’, ‘দেখা’, ‘ধরা’ ইত্যাদি। যেমন, আপনি যখন এই ইউনিট পড়বেন, আপনি বুঝতে পারবেন যে শিশু মূলত তার সংবেদনশীলতা এবং কাজের মাধ্যমে তার পরিবেশ সম্পর্কে জানতে পারে। পরে ১৮ মাস থেকে ২ বছর বয়সে, স্কিমাস আর শুধু মোটর ক্রিয়া-প্যাটার্ন থাকে না, বরং মানসিক ধাঁচের হয়। তখন শিশু বস্তু এবং ঘটনাগুলিকে মানসিকভাবে ভাবতে শুরু করে, যদিও তা সেই মুহূর্তে উপস্থিত না থাকলেও। এছাড়াও, তারা সমস্যা সমাধানের ক্ষমতাও বিকাশ করতে থাকে, শুধুমাত্র জিনিসের ওপর ক্রিয়া করে নয়, বরং চিন্তা করে সমস্যার সমাধান করতে শেখে।

এটা পরিষ্কার যে পিয়াজের তত্ত্ব শিশুদের চিন্তার বিকাশে গভীর অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করে, যা শিক্ষার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে।

২) অ্যাডাপ্টেশন (Adaptation): পিয়াজের মতে, অ্যাডাপ্টেশন হলো সেই প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে আমরা আমাদের চারপাশের পরিবেশের সাথে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে আমাদের মনে স্কিমাস তৈরি করি। এটি দুটি পরিপূরক প্রক্রিয়া নিয়ে গঠিত: অ্যাসিমিলেশন এবং অ্যাকোমোডেশন

৩) অ্যাসিমিলেশন (Assimilation):

এই প্রক্রিয়ায়, আমরা আমাদের চারপাশের পরিবেশ থেকে যা কিছু দেখি বা বুঝি তা আমাদের মনের বিদ্যমান স্কিমাসে ‘অ্যাসিমিলেট’ বা অন্তর্ভুক্ত করি। উদাহরণস্বরূপ, শিশু তাদের 'চোষার স্কিমা' বা চোষা মোটর ক্রিয়া প্যাটার্নে সবকিছু অ্যাসিমিলেট করে এবং যা কিছু তাদের সামনে আসে তা চুষতে শুরু করে। তারা ‘ফেলা’, ‘আঘাত করা’ এবং ‘ধরা’ ধরনের মোটর ক্রিয়া প্যাটার্নে সবকিছুকে অন্তর্ভুক্ত করে—যা কিছু তারা পায়, তা ফেলে বা আঘাত করে। বড় বাচ্চাদের ক্ষেত্রে, যেমন একটি শিশুর একটি কুকুর সম্পর্কে ধারণা থাকলে এবং সে একটি বিড়াল দেখে, সে বিড়ালটিকে 'কুকুর' বলে ডাকতে পারে কারণ সে তাদের মধ্যে কিছু সাদৃশ্য দেখতে পায়। এটি হলো নতুন তথ্য বা অভিজ্ঞতাকে আগের বিদ্যমান স্কিমায় অ্যাসিমিলেট করার প্রক্রিয়া।

৪) অ্যাকোমোডেশন (Accommodation):

এই প্রক্রিয়ায়, আমরা নতুন স্কিমাস তৈরি করি বা আমাদের পুরনো স্কিমাগুলোকে সংশোধন করি যখন আমরা বুঝতে পারি যে আমাদের বিদ্যমান আচরণের ধরণ বা চিন্তার পদ্ধতি পরিবেশের সাথে মেলে না। উদাহরণস্বরূপ, শিশু যখন বোতল থেকে দুধ খায়, তখন তারা বোতলের নিপল চোষার পদ্ধতি তাদের মায়ের স্তন চোষার থেকে ভিন্নভাবে অ্যাকোমোডেট করে। তারা হাতের কাজও পরিবর্তন করে, যেমন তারা আঙুল বা অন্য কিছু ধরার ক্ষমতা বাড়ায় এবং র‍্যাটল বা খেলনা ধরতে পারে। ধীরে ধীরে, শিশুদের ‘ধরার স্কিমা’ও উন্নতি লাভ করে, যেমন পুরো হাত দিয়ে কিছু ধরা থেকে শুরু করে আঙুল ও বৃদ্ধাঙ্গুলি দিয়ে ছোট জিনিস ধরা (পিন্সার গ্রাস) পর্যন্ত।

একইভাবে, তারা 'ফেলা' স্কিমাটিও পরিবর্তন করে এবং বিভিন্ন পদ্ধতিতে বস্তু ফেলে বিভিন্ন ফলাফল দেখতে শেখে। পূর্বের উদাহরণে শিশুটি বিড়ালকে কুকুর বলে ডাকলেও, যখন সে বারবার বিড়ালের সাথে মিথস্ক্রিয়া করে এবং দুটোর মধ্যে পার্থক্য উপলব্ধি করে, তখন সে নতুন তথ্যের আলোকে তার মানসিক কাঠামো পরিবর্তন করে এবং বিড়ালের জন্য আলাদা ধারণা তৈরি করে।

৫) সমীকরণ (Equilibration): পিয়াজের মতে, অ্যাসিমিলেশন এবং অ্যাকোমোডেশন প্রক্রিয়ার মধ্যে ভারসাম্য সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়। যখন শিশু নতুন তথ্যকে তাদের বিদ্যমান স্কিমাসে অন্তর্ভুক্ত করে এবং অ্যাকোমোডেশন প্রক্রিয়ার চেয়ে অ্যাসিমিলেশন প্রক্রিয়াকে বেশি প্রাধান্য দেয়, তখন এটি শিশুর মনের জন্য একটি আরামদায়ক বা সমীকরণ অবস্থার প্রতিনিধিত্ব করে। এটি হলো সেই অবস্থা যেখানে শিশুটি তার পরিবেশের সাথে মানিয়ে চলতে স্বস্তি অনুভব করে।

তবে, যখন শিশু নতুন তথ্যকে তার বিদ্যমান স্কিমার সাথে মেলাতে পারে না, তখন শিশুটি মানসিক অস্বস্তি বা ‘ডিজ়ইকুইলিব্রিয়াম’ অবস্থায় থাকে। এই সময়ে, শিশুটি অ্যাসিমিলেশনের পরিবর্তে অ্যাকোমোডেশনের দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং তার মানসিক কাঠামোকে (স্কিমা) নতুন তথ্যের সাথে মানানসই করে পরিবর্তন বা নতুন স্কিমা তৈরি করে। একবার শিশুটি তার স্কিমাগুলিকে পুনরায় সামঞ্জস্য করার পর, সে আবার সমীকরণ অবস্থায় ফিরে আসে এবং অ্যাসিমিলেশন প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করে যতক্ষণ না নতুন কিছু পরিবর্তন আনার প্রয়োজনীয়তা আবার দেখা দেয়।

এভাবে শিশুটি অসামঞ্জস্য (ডিজ়ইকুইলিব্রিয়াম) অবস্থা থেকে সমীকরণের দিকে ফিরে আসে, এবং এই প্রক্রিয়াকেই বলা হয় সমীকরণ (Equilibration)। আমাদের সকলের মনেই একটি স্বাভাবিক প্রয়োজন থাকে সমীকরণ বা মানসিক সামঞ্জস্য বজায় রাখার।

৬) সংগঠন (Organization):

পিয়াজে দাবি করেন যে শিশুরা শুধু নতুন স্কিমা তৈরি বা পুরনো স্কিমাগুলিকে পরিবর্তন করে না, বরং এই স্কিমাগুলিকে নিজেদের মনে পুনরায় সংগঠিত করে এবং একে অপরের সাথে যুক্ত করে একটি শক্তিশালী আন্তঃসংযুক্ত জ্ঞানীয় ব্যবস্থা গড়ে তোলে। এই প্রক্রিয়াকে পিয়াজে সংগঠন (Organization) বলে অভিহিত করেছেন। এভাবেই শিশুদের মানসিক বিকাশ এক ধাপ থেকে পরবর্তী ধাপে অগ্রসর হয়।

এখন, পিয়াজের এই মূল ধারণাগুলি মাথায় রেখে, আমরা কগনিটিভ বিকাশের বিভিন্ন ধাপ সম্পর্কে আলোচনা করবো, বিশেষত প্রথম দুই বছরের মধ্যে ঘটে যাওয়া সংবেদী-মোটর পর্বের (Sensori-Motor Period) বিকাশ নিয়ে।

পিয়াজের জ্ঞানীয় বিকাশ তত্ত্ব অনুযায়ী, জ্ঞানীয় বিকাশ সর্বজনীনভাবে চারটি ধাপে অগ্রসর হয়। একজন ব্যক্তি যখন উঁচু ধাপে পৌঁছে যায়, তখন তার চিন্তাধারা আরও সুক্ষ্ম ও পরিশীলিত হয়ে ওঠে। প্রথম তিনটি ধাপ জন্ম থেকে প্রায় এগারো বছর বয়স পর্যন্ত বিস্তৃত, যা মূলত শৈশবকালীন পর্যায়ের সাথে সম্পর্কিত। চতুর্থ ধাপটি হল সর্বোচ্চ ধাপ, যা মূলত কৈশোরকাল থেকে প্রাপ্তবয়স্ক অবধি বিস্তৃত। তত্ত্ব অনুযায়ী, সকল মানুষ সর্বোচ্চ ধাপে পৌঁছায় না। এছাড়াও, জ্ঞানীয় বিকাশ এক ধাপ থেকে সরাসরি আরেক ধাপে ঘটে না; প্রতিটি ধাপের মধ্যেই একটি বিকাশের ক্রম রয়েছে। এই ধাপগুলো হলো –

  • সেন্সরি-মোটর স্টেজ
  • প্রি-অপারেশনাল স্টেজ
  • কংক্রিট অপারেশনাল স্টেজ
  • ফর্মাল অপারেশনাল স্টেজ

সেন্সরি-মোটর স্টেজ (জন্ম থেকে ২ বছর):

এই ধাপটি জন্ম থেকে দুই বছর পর্যন্ত বিস্তৃত। নাম থেকেই বোঝা যায়, এই সময় শিশুরা মূলত তাদের ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে জগৎটাকে বোঝার চেষ্টা করে – স্পর্শ করা, স্বাদ নেওয়া, শোনা, দেখা এবং অনুভব করা। এই সময়ে শিশুর আচরণ সাধারণত প্রাকৃতিক প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে প্রকাশ পায়, যেমন চোষা বা কান্না করা। বয়স বাড়ার সাথে সাথে তারা আরও জটিল শারীরিক ক্রিয়াকলাপ করতে সক্ষম হয়, যেমন হামাগুড়ি দেওয়া, শরীর নড়ানো, শব্দ করা ইত্যাদি। এই ধাপের শেষের দিকে, তারা লক্ষ্যভিত্তিক ক্রিয়াকলাপেও অংশ নিতে সক্ষম হয়, যেমন কেউ তাদের তাড়া করলে তারা পালায় বা খেলনা বাক্স থেকে খেলনা বের করে আবার সেখানে রাখতে পারে। এই ধাপে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য বিকাশ ঘটে:

  • প্রতিক্রিয়াগুলির সমন্বয়
  • শরীরের নড়াচড়ার উপর বেশি নিয়ন্ত্রণ
  • সহজ মোটর ক্রিয়াকলাপের সমন্বয়

আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন হল বস্তু স্থায়িত্ব (object permanence), যেখানে শিশুটি বুঝতে শেখে যে কোনো বস্তু তাকে দৃশ্যত অনুপস্থিত থাকলেও তা অস্তিত্ব বজায় রাখে। আপনি হয়ত দেখেছেন যে ছোট বাচ্চাদের মনোযোগ সহজেই অন্যদিকে সরিয়ে কোনো বস্তু নেওয়া যায়। তবে, দুই বছর বয়সের কাছাকাছি এসে, শিশুটি তার খেলনা খোঁজে, এমনকি সেটি দৃশ্যমান না হলেও। ভাষার বিকাশও এই ধাপে শুরু হয়। প্রথমে কিছু বকবক ধ্বনি থেকে ভাষার প্রাথমিক ইঙ্গিত দেখা দেয়, যা পরবর্তী ধাপে আরও স্ফুটভাবে বিকশিত হয়।

প্রি-অপারেশনাল স্টেজ (২ থেকে ৭ বছর):

এই ধাপটি দুই থেকে সাত বছর বয়স পর্যন্ত বিস্তৃত এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ শিশুরা এই ধাপের শেষের দিকে স্কুলে যেতে শুরু করে। আগের ধাপে বর্ণিত মানসিক প্রক্রিয়াগুলো এই ধাপে বেশ শক্তিশালী হয়, তবে কিছু সীমাবদ্ধতা থাকে। এই ধাপের শিশু শারীরিকভাবে কোনো কাজ করতে পারলেও মানসিকভাবে তা কল্পনা বা উল্টাতে পারে না। মানসিকভাবে একটি কাজ করা বা তা বিপরিতর ক্ষমতাকে বলা হয় অপারেশনাল চিন্তা। যেহেতু এই দ্বিতীয় ধাপটি এমন অপারেশনাল চিন্তার পূর্ববর্তী ধাপ, তাই একে প্রি-অপারেশনাল স্টেজ বলা হয়। এই ধাপেই সেই অপারেশনাল চিন্তার জন্য প্রস্তুতি শুরু হয়। এর প্রথম পদক্ষেপ হলো একটি ভাষা ব্যবস্থার বিকাশ। শিশুরা এমন বস্তুগুলোর নামকরণ করতে শেখে যা তারা সরাসরি দেখতে পায় না। উদাহরণস্বরূপ, তারা একটি আপেলের ছবি দেখলে সেটিকে চিনতে পারে। তারা প্রতীকী ক্রিয়াকলাপেও দক্ষ হয়, যেমন খালি কাপ থেকে চা খাওয়ার ভান করা।

এই রূপান্তরের মাধ্যমে শিশুদের চিন্তাশক্তি আরও বিকশিত হতে থাকে এবং পরবর্তী ধাপগুলোর জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়।

তবে, এই পর্যায়ে শিশুর চিন্তাভাবনা মূলত একমুখী যুক্তি ব্যবহার করে। নিম্নলিখিত পরিস্থিতির মাধ্যমে এটি বোঝা যায় (Woolfolk, 2004, পৃ. 67):

পরিস্থিতি:
রিঙ্কু (৫ বছর বয়সী) এবং তার শিক্ষিকা সুমন একটি কার্যকলাপে কাজ করছে। সুমন রিঙ্কুকে দুটি অভিন্ন গ্লাস দেখায়, যেগুলিতে সমান পরিমাণ জল রয়েছে।
সুমন জিজ্ঞেস করলেন: "রিঙ্কু, এই গ্লাসগুলোতে কি সমান পরিমাণ জল আছে, নাকি কোনো একটাতে বেশি?"
রিঙ্কু বলল: "সমান জল আছে!"
এরপর সুমন এক গ্লাসের জল লম্বা একটি গ্লাসে এবং অন্য গ্লাসের জল একটি চওড়া গ্লাসে ঢালল।
সুমন আবার জিজ্ঞেস করলেন: "এখন বলো, গ্লাসগুলোতে কি সমান জল আছে, নাকি কোনো একটাতে বেশি?"
রিঙ্কু লম্বা গ্লাসটি বেছে নিয়ে বলল: "এটাতে বেশি!"
সুমন জিজ্ঞেস করলেন: "কেন?"
রিঙ্কু লম্বা গ্লাসটির জলর স্তরের দিকে ইঙ্গিত করে বলল: "দেখো, এটা বেশি।"

এই কাজটি সংরক্ষণ (conservation) তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে। এই তত্ত্ব অনুযায়ী, কোনো বস্তুর চেহারায় পরিবর্তন হলেও তার বৈশিষ্ট্য অপরিবর্তিত থাকে। কিন্তু রিঙ্কু এই ধারণাটি এখনও শিখতে পারেনি। সে বোঝে না যে চওড়া গ্লাসের প্রস্থ লম্বা গ্লাসের উচ্চতাকে ভারসাম্য করতে পারে। রিঙ্কু শুধুমাত্র জলর স্তরের উচ্চতার দিকে মনোযোগ দিচ্ছে। অর্থাৎ, সে এক সময়ে কেবল একমাত্রিক বা এক দিকেই মনোনিবেশ করতে পারছে। সে একাধিক দিক একসঙ্গে বিবেচনা করতে পারছে না (চওড়া দিকটি অবহেলা করছে)। এছাড়াও, সে তার চিন্তাকে উল্টাতে পারছে না (জলর সমান পরিমাণ ছিল যখন সেটি অভিন্ন গ্লাস থেকে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল, এই বিষয়টি বুঝতে পারছে না)।

এছাড়া, শ্রেণীকরণ (classification) এবং ক্রমবিন্যাস (seriation) এর মতো আরও কিছু ধারণা রয়েছে, যা সম্পূর্ণরূপে বিকশিত হয়নি এবং যা সংরক্ষণ ক্ষমতার সাথে সম্পর্কিত। আমরা পরবর্তী ধাপে এই ধারণাগুলি সম্পর্কে আরও জানব।

শুধু একাধিক দিক বা মাত্রা বিবেচনা করতে না পারা নয়, এই বয়সের শিশুরা অন্যের দৃষ্টিভঙ্গিও বিবেচনা করতে পারে না। উদাহরণস্বরূপ, একটি পাঁচ বছরের শিশু মনে করে যে যেহেতু সে দৌড়াতে ভালোবাসে, তার মা-ও দৌড়াতে ভালোবাসেন। তাই সে তার মাকে জোর করে দৌড়াতে বলে। একে বলে স্বকেন্দ্রিকতা (egocentrism), যেখানে শিশু কেবল নিজের দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই চিন্তা করে।

এছাড়াও, আমরা প্রায়শই তিন থেকে ছয় বছর বয়সী শিশুদের দেখি যে তারা একটি দলের মধ্যে থাকলেও একে অপরের কথা শোনে না এবং সম্পর্কহীন বিষয়ে কথা বলে, এমনকি নিজের সাথে কথা বলে। এটিও স্বকেন্দ্রিকতার ফল, এবং একে বলে সমষ্টিগত সংলাপ (collective monologue)। এটি একটি কারণ যে এক বা দুই শ্রেণির শিশুরা প্রায়শই 'স্বার্থপর' মনে হতে পারে এবং শিক্ষকের নির্দেশনা মানতে কম সক্ষম বলে মনে হতে পারে। তবে শিক্ষকের বুঝতে হবে যে এটি ইচ্ছাকৃত নয়, বরং এটি তাদের অভিজ্ঞতায় থাকা ধাপের বিকাশের একটি বৈশিষ্ট্য।

এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল যে সংরক্ষণ, বহুমাত্রিক চিন্তাভাবনা এবং চিন্তাকে বিপরিত হলো সেই মৌলিক প্রক্রিয়া, যার উপর গাণিতিক ধারণা এবং ব্যাকরণ, পড়াশোনা ও লেখার শিক্ষা নির্ভর করে। প্রি-অপারেশনাল ধাপে থাকা শিশু এই ক্ষমতাগুলো প্রয়োগের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত নয়। তাই, এই বিষয়গুলিতে শিক্ষাদান ভিন্নভাবে সংগঠিত করতে হবে। শিক্ষকের জন্য এই উপলব্ধিগুলি শিক্ষাদানের উপর কী প্রভাব ফেলবে, তা খেয়াল রাখতে হবে।

কগনিটিভ বিকাশের পরবর্তী ধাপ:

Concrete Operational Stage (সুনির্দিষ্ট কার্যকর ধাপ):
এই ধাপটি সাত বছর থেকে এগারো বছরের মধ্যে বিস্তৃত, যা মূলত মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সময়কালের অন্তর্ভুক্ত। এই পর্যায়ে শিশুদের চিন্তাশক্তি আরও উন্নত হয় এবং তারা এখন মানসিকভাবে বিভিন্ন প্রক্রিয়া (যেমন চিন্তাভাবনার বহুমাত্রিকতা এবং ক্রিয়ার বিপরিত) পরিচালনা করতে পারে। ফলে, তারা সংরক্ষণ নীতির ব্যবহার করতে সক্ষম হয়। এখন তারা বুঝতে পারে যে লম্বা এবং চওড়া পাত্রে জলর পরিমাণ সমান হতে পারে, এমনকি যদি লম্বা পাত্রের জলর স্তর উচ্চতর হয়। এই পর্যায়ে শিশুরা নিম্নলিখিতভাবে চিন্তা করতে সক্ষম হয় (Woolfolk 2004, পৃ. 68):

  • সংযোজন এবং বিয়োজন: শিশুরা বুঝতে শেখে যে কোনো বস্তুতে যদি একই পরিমাণ যোগ বা বিয়োজন করা হয়, তবে মোট পরিমাণ অপরিবর্তিত থাকে।
  • শ্রেণীকরণ: শিশুরা এখন বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে বস্তুকে শ্রেণীকরণ করতে পারে, যেমন বিভিন্ন আকৃতির মধ্যে থেকে শুধু চতুর্ভুজ আকৃতির বস্তুগুলি আলাদা করে ফেলা।
  • ক্রমবিন্যাসের যুক্তি: শিশুরা এমন ধরণের যুক্তি প্রয়োগ করতে পারে, যেমন A < B < C। তারা বোঝে যে B, A-এর চেয়ে বড় কিন্তু C-এর চেয়ে ছোট হতে পারে।
  • বিপরিত চিন্তাভাবনা: তারা এখন বুঝতে পারে যে যদি ৪ + ২ = ৬ হয়, তবে ৬ – ২ = ৪ হবে।

সংক্ষেপে, এই ধাপে শিশু আগের ধাপের বেশিরভাগ সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে। তারা এখন অন্যের দৃষ্টিভঙ্গি বুঝতে শেখে, যা স্বকেন্দ্রিকতা থেকে মুক্তির দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। শিশুরা ধীরে ধীরে সংবেদী বা দৃশ্যমান জগত থেকে সরে এসে আরও প্রতীকভিত্তিক এবং যৌক্তিক চিন্তাভাবনার দিকে এগোয়, তবে এই চিন্তাভাবনা এখনও বাস্তব বা বস্তুগত জগতের উপর ভিত্তি করে থাকে। এই ধাপের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো বিপরিত চিন্তাশক্তি যা নতুন শিক্ষার সুযোগ তৈরি করে।

এই পর্যায়ে শিশুরা অনেকটাই প্রাপ্তবয়স্কদের মতো যৌক্তিক চিন্তাভাবনা করতে সক্ষম হয়, তবে তাদের যুক্তি এখনও বাস্তব বা স্পষ্ট বস্তুসমূহের সাথে সম্পর্কিত থাকে। অর্থাৎ, তারা এখনো বিমূর্ত চিন্তায় পারদর্শী নয়। এ কারণেই এই ধাপটিকে বলা হয় কনক্রিট অপারেশনাল স্টেজ—কারণ শিশুরা যুক্তি প্রয়োগ করতে পারে, কিন্তু তা কেবল বাস্তব জগতের সাথে সম্পর্কিত।

ফরমাল অপারেশনাল স্টেজ (গঠনমূলক কার্যকর ধাপ):
এই ধাপটি প্রায় ১১ বছর থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত বিস্তৃত থাকে। এটি চিন্তার বিকাশের সর্বোচ্চ ধাপ হিসেবে বিবেচিত, এবং অনেকেই এই পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে না। এই পর্যায়ে শিশুরা কল্পনাশক্তির ব্যবহার এবং বিমূর্ত চিন্তাভাবনার ক্ষমতা অর্জন করতে থাকে। এখন তাদের চিন্তা আর কেবল বাস্তব বা দৃশ্যমান বস্তুর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; তারা প্রতীক (যেমন সংখ্যা) ব্যবহার করে চিন্তা করতে পারে।

বিমূর্ত চিন্তাভাবনা:
গণিত ও ব্যাকরণের মতো বিষয়গুলোতে বিমূর্ত চিন্তাভাবনার প্রয়োজন হয়, কারণ এই বিষয়গুলোতে ছাত্রদের প্রতীক এবং দৃশ্যমান বাস্তবতার বাইরের ধারণার সাথে কাজ করতে হয়। শুধুমাত্র এই পর্যায়ে এসে শিশুরা এমনভাবে চিন্তা করতে শেখে যা তাদের গণিতের উচ্চতর বিষয়বস্তু বুঝতে সক্ষম করে। উদাহরণস্বরূপ, সিলোজিজম-এর মাধ্যমে তারা যৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিতে পারে, যেমন:

  • সকল মানুষই নশ্বর।
  • সক্রেটিস একজন মানুষ।
  • সক্রেটিস নশ্বর।

এ ধরনের চিন্তাভাবনা হাইপোথেটিক্যাল এবং ডিডাকটিভ রিজনিং বা অনুমানের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা অর্জন করে। যখন ছাত্ররা "ধরি x = y" এর মতো বিমূর্ত ধারণা বুঝতে পারে অথবা কবিতার অর্থ বুঝতে পারে, তখন তাদের চিন্তার গভীরতা স্পষ্ট হয়। এই ধাপে শিক্ষার্থীদের আরও সৃজনশীলতা এবং বিমূর্ত যুক্তির কাজে প্রবৃত্ত করা যায়।

তবে, শিক্ষকের এ বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে যে কেবলমাত্র ১১ বছর পূর্ণ হলেই বিমূর্ত চিন্তার ক্ষমতা স্বাভাবিকভাবে তৈরি হয়ে যাবে না। এটি একটি প্রক্রিয়া যা সময়ের সাথে বিকশিত হয় এবং প্রত্যেকের ক্ষেত্রেই ঘটে না। তাই শিক্ষকদের বিষয়বস্তু নির্বাচন এবং শিখন-শেখানোর পদ্ধতি শিশুদের বিকাশের ধাপের উপর ভিত্তি করে সাজাতে হবে।

পাঠ্যক্রম এবং ক্লাসরুমে পিয়াজের তত্ত্বের প্রয়োগ:
পিয়াজের তত্ত্ব অনুযায়ী, শিশু যত বড় হয়, তার মানসিক প্রক্রিয়ায় গুণগত পরিবর্তন আসে। এই পরিবর্তনকে বিভিন্ন ধাপে বুঝানো যায় যা কগনিটিভ বিকাশের রূপরেখা তৈরি করে। শিখনের ক্ষমতা এই বিকাশের ধাপের সাথে সম্পর্কিত। একটি নির্দিষ্ট ধাপের শিশুরা উচ্চতর ধাপের ধারণা বুঝতে পারবে না। তাই পাঠ্যক্রম, শিক্ষাদান পদ্ধতি, এবং মূল্যায়ন শিক্ষার্থীদের বিকাশের ধাপ অনুযায়ী সাজানো উচিত। পাশাপাশি, শিক্ষার্থীদের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি এবং নতুন কিছু শেখার জন্য তাদের প্রস্তুত করতে হবে (পিয়াজের তত্ত্বের প্রাথমিক ধারণাগুলি এখানে গুরুত্বপূর্ণ)।

এই তত্ত্ব অনুসারে, পাঠ্যক্রম এবং ক্লাসরুমের কার্যক্রমগুলো এমনভাবে সাজাতে হবে যাতে শিক্ষার্থীরা সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে নিজেদের মধ্যে কগনিটিভ বৈষম্য অনুভব করে এবং সমাধানের পথে এগিয়ে যায়। এভাবে সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে শিখন-শেখানো কার্যক্রম পরিচালিত হবে।



Post a Comment

Please Select Embedded Mode To Show The Comment System.*

Previous Post Next Post